পাবনার ভাঙ্গুড়ায় একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে লাইব্রেরি কক্ষে চৌকি পেতে নিয়মিত বিশ্রাম করার অভিযোগ উঠেছে। প্রধান শিক্ষকের এমন অমার্জিত কর্মকাণ্ডে অন্যান্য শিক্ষক ও অভিভাবকদের মাঝে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
এর আগেও ওই প্রধান শিক্ষক তার নিজ অফিস কক্ষে খাট পেতে বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছিলেন। এ ছাড়া তার স্ত্রী বিদ্যালয়ের কর্মচারীদের দিয়ে কাপড় ধোয়া, খাবার রান্না করাসহ ব্যক্তিগত কাজ করিয়ে নেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ওই শিক্ষকের নাম শওকত আলী। তার স্ত্রীর নাম আঞ্জুয়ারা বেগম। শওকত আলী ভাঙ্গুড়া উপজেলা সদরে অবস্থিত জরিনা রহিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তার স্ত্রী ওই বিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শওকত আলী ২০০৪ সালে বিধি বহির্ভূতভাবে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পান। সেসময় প্রধান শিক্ষক হওয়ার কাম্য যোগ্যতা না থাকায় প্রায় তিন বছর তিনি এমপিওভুক্ত হননি। এরপর ২০১২ সালে শওকত আলী দারুল এহসান ইউনিভার্সিটির জাল সনদধারী নিজ স্ত্রী আঞ্জুয়ারা বেগমকে সহকারী গ্রন্থাগার পদে নিয়োগ দেন।
আঞ্জুয়ারা বেগম জাল সনদের অভিযোগ এড়াতে পরবর্তীতে আরেকটি প্রতিষ্ঠান থেকে লাইব্রেরিয়ান ডিগ্রি অর্জন করেন।
তবে এর আগে থেকেই আঞ্জুয়ারা বেগম স্বামীর সঙ্গে বিদ্যালয়ে এসে সময় কাটাতেন এবং বিদ্যালয়ের কর্মচারীদের দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করাতেন। সেসময়ও প্রধান শিক্ষক অফিস কক্ষে খাট পেতে নিজে ও স্ত্রীর বিশ্রামের ব্যবস্থা করেন। এ নিয়ে চরম সমালোচনার সৃষ্টি হলেও শওকত আলী তার শ্বশুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান আমির হোসেনের প্রভাবে কাউকেই তোয়াক্কা করেননি।
অবশেষে এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের তদন্তে বিধি বহির্ভূতভাবে প্রধান শিক্ষকের নিয়োগ, প্রধান শিক্ষকের স্ত্রীর নিয়োগে অনিয়ম, প্রধান শিক্ষক ও তার স্ত্রীর স্বেচ্ছাচারি এবং বিদ্যালয়ের ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত হন প্রধান শিক্ষক। এতে রাজশাহী অঞ্চলের তৎকালীন উপ-পরিচালক ড. রেবেকা সুলতানা ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা দপ্তরে প্রতিবেদন পাঠান।
এরপর ২০১৭ সালে মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশ মোতাবেক তৎকালীন কমিটি ২০১৭ সালের ২০ মার্চ শওকত আলীকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। এ ছাড়া ২০১৮ সালে মে মাসে প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ফারুক হোসেন আদালতে একটি মামলা করেন। এই মামলায় শওকত আলী দুই সপ্তাহ কারাভোগ করেন।
এ অবস্থায় দীর্ঘ আট বছর সাময়িক বহিষ্কার থাকার পর সহকারী ফারুক হোসেনকে ম্যানেজ করে গত বছর নভেম্বর মাসে মামলা প্রত্যাহার করিয়ে নেন প্রধান শিক্ষক শওকত আলী। এতে চলতি বছরের মে মাসে তিনি পুনরায় প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব ফিরে পান। দায়িত্ব পাওয়ার পরেই তিনি আবারও স্বেচ্ছাচারি ও অনিয়ম শুরু করেছেন বলে শিক্ষকরা অভিযোগ করেছেন। যোগদানের পরের সপ্তাহেই শিক্ষক স্টাফদের রুম পরিবর্তন করে লাইব্রেরি কক্ষ করে চৌকি পারেন।
এদিকে, প্রধান শিক্ষক শওকত আলীর বিরুদ্ধে নথি জালিয়াতি করে এক যুগ আগে পাঁচজন শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ চলতি বছর মার্চ মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা হয়। এ বিষয়ে শিক্ষা বোর্ড তদন্ত করলে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত আগস্ট মাসে আবারও প্রধান শিক্ষকের বেতন বন্ধসহ ব্যবস্থা নিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেন। তবে প্রধান শিক্ষক মাউশিকে ম্যানেজ করে বিষয়টি ধামাকা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, লাইব্রেরি কক্ষের দরজা ভেতর থেকে আটকানো। এক পর্যায়ে অনেক ডাকাডাকি করলে তার স্ত্রী দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন। এ সময় চৌকির ছবি তুলতে গেলে প্রধান শিক্ষক ও তার স্ত্রী ছবি তুলতে বাধা দিয়ে হট্টগোল শুরু করেন।
ভাঙ্গুড়া বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক বলেন, বর্তমান প্রধান শিক্ষের অমার্জিত কর্মকাণ্ডে উপজেলা সদরের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানটি নষ্ট হয়ে গেছে। পরিবেশ নষ্ট হওয়ায় কোনো ভালো পরিবারের মেয়েদের ওই স্কুলে পড়ানো হয় না। দ্রুত এমন অবস্থার পরিবর্তন করে নারী শিক্ষা বিস্তারে প্রশাসনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
অভিযোগের বিষয়ে প্রধান শিক্ষক শওকত আলী বলেন, চৌকিতে শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্রীরা বিশ্রাম নেয়। আমি বিশ্রাম করি না। বিদ্যালয়ে বিশ্রামের জন্য চৌকি রাখা যুক্তিসংগত কিনা জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ ছাড়া অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে পারবেন না বলে জানান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি তাপস পাল বলেন, এমন কর্মকাণ্ড ন্যক্কারজনক। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রথমা আলো